ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ঠাকুরগাঁওয়ে তানভীর হাসান তানু নামের এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঠাকুরগাঁওয়ে আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের করা মামলায় শনিবার (১০ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টায় এই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার দেখায় সদর থানা-পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃত সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু দৈনিক ইত্তেফাক ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজেরও জেলা প্রতিনিধি।
তানুর পরিবার বলছে, শনিবার রাতে সে মামলার বিষয়ে থানায় খোঁজ নিতে গেলে পুলিশ তাকে আটক করে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তানভীরুল ইসলাম জানান, রোববার সকালে তাকে আদালতে হাজির করা হবে।
এদিকে সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাজত থেকে হাসপাতালে নিয়েছে সদর থানা পুলিশ। শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে তানুর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। পরে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
গত ৫ তারিখেই তানভীর হাসান তানু সস্ত্রীক করোনা থেকে সুস্থ হন। তবে, এখনও তিনি শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করছেন। তাকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
ওসি তানভীরুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিক তানু হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করেন। দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি আমাকে জানালে আমি তাকে হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই।
গত ৬ ও ৭ জুলাই জাগো নিউজ, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাসহ বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে বলা ছিল, ঠাকুরগাঁও জেলা সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের খাবারের জন্য প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও, তাদের নিম্নমানের খাবার দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন রোগী ও তার স্বজনরা। তারা বলছেন, তিন বেলা যে খাবার তাদের দেয়া হচ্ছে, তার দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা হবে।
তানভীর হাসান তানু
এই সংবাদ প্রচারের পরেই গত ৯ জুলাই ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজ বাদী হয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)(ক) ২৫(১)(খ) ২৯(১)/৩১(১)/৩৫(১) ধারায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় তানভীর হাসান তানু, নিউজবাংলা ২৪ ডট কমের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি রহিম শুভ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ ২৪ চ্যানেলের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটুকে আসামি করা হয়। মামলার একদিন পরেই তানভীর হাসান তানুকে গ্রেপ্তার করা হলো।
বিস্ময়কর হলো মামলার এজাহারেই হাসপাতালে খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটার কথাটি স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, লকডাউনের কারণে খাদ্য সরবরাহে ২/১ দিন ‘সামান্য ব্যত্যয়’ হয়েছে।
আবার সংবাদটিকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, জনরোষ সৃষ্টিকারী মানহানিকর উল্লেখ করে এজাহারে এও দাবি করা হয় যে, এই সংবাদ প্রকাশের উদ্দেশ্য অসৎ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও সুনাম ক্ষুণ্ন করা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মতো অভিযোগও আনা হয় মামলায়।
এমন দুর্বল অভিযোগ থাকার পরেও তড়িঘড়ি করে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার এক নম্বর আসামি থানায় এসেছিলেন। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
ঊর্ধ্বতন সেই কে?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসামি থানায় আসার পর তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন। আমি পুলিশ সুপার মহোদয়কে জানিয়েছি। তার নির্দেশক্রমেই গ্রেপ্তার হয়েছে।’
গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো চাপ ছিল কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা স্বাধীন। তিনি আসামিকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে আমি কিছু বলতে পারি না।’
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটার নিরাপত্তা আইনে মামলা ও সাংবাদিক তানভির হাসান তানুকে গ্রেপ্তার করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাব, ঠাকুরগাঁও টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, ঠাকুরগাঁও অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতাসহ ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক মহল।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জেলার সংবাদকর্মীরা প্রেসক্লাবে তাৎক্ষণিক অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
অনিয়মের সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে নিন্দা জানান ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি মনসুর আলী। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের এই সময়ে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলায় অপ্রতুল উদ্যোগের কথাগুলো তুলে ধরে সমাধানের পথ খুঁজতে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে সাংবাদিকরা। তখন গণমাধ্যমের ওপর আঘাত আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাকেই বিপন্ন করবে।
তিনি আরো বলেন, সাংবাদিক তানভীর হাসান তানুর নিঃশর্ত মুক্তির পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় সাংবাদিকেরা রাজপথে অবস্থান নেবে এবং আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।