সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় দেড় মাস ধরে আন্দোলন করছেন বিশিষ্টজনসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত এ আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করেছেন নগরের মেয়রসহ ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন এমপি। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগরে শীর্ষ নেতারাও এসেছেন সিআরবিতে। সিআরবি ছাড়া চট্টগ্রামের অন্য যে কোনো স্থানে হতে পারে হাসপাতাল- এমন বক্তব্য রেখে নানা কর্মসূচি দিয়েছেন তারা। কিন্তু এখন ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে শীর্ষ অনেক নেতার মুখে।
এত দিন হাসপাতালের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল শুধু সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের। এখন নগরের দুই এমপি ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও মোসলেম উদ্দিন আহমেদও হাঁটছেন সেই পথে। একই অবস্থান নিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগ, উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতিরাও। তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ড. অনুপম সেন, সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগরের দুই সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান এখনও আছেন আন্দোলনের মাঠে। তারা বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধিতা’ বলে এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে একটি মহল।
মধ্যম সারির কিছু নেতা সিআরবির সবুজ রক্ষার পক্ষে থাকলেও এই ইস্যুতে চট্টগ্রামের মূলধারার আওয়ামী লীগ এখন জনমতের বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। হাসপাতাল প্রকল্পের বিপক্ষে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহাতাব উদ্দীন চৌধুরীও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন তিনিই কথা বলছেন অন্য সুরে। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে নগর আওয়ামী লীগের পদধারী যেসব নেতা আন্দোলন করছেন, উল্টো তাদেরই সমালোচনা করেছেন বর্ষীয়ান এ নেতা।
বুধবার মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষে সিআরবি ইস্যুতে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। মাহাতাব উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘দলকে পাশ কাটিয়ে এভাবে ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আন্দোলন করার অর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা। এটির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত আছেন, তারা দলীয় পরিচয় ব্যবহার করবেন না।’
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনও সভায় একই কথা বলেন। তার ভাষ্য- ‘এ প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেছে। তারা এটি যাচাই-বাছাই করেছে। এখন যদি আমরা এর বিরোধিতা করি, তাহলে অর্থ কী দাঁড়ায়?’
সিআরবি ইস্যুতে গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের তিন ইউনিট- মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার শীর্ষ নেতারা একসঙ্গে হাসপাতাল নির্মাণস্থল পরিদর্শন করেন। তখন সবাই হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধেই তাদের মতামত জানান। এখন দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ছাড়া সিআরবি রক্ষার পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলছেন না কেউই। উত্তর জেলার সভাপতি এমএ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আগে সিআরবির পক্ষে কথা বলেছিলেন। এখন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত’ মনে করে আন্দোলন থেকে কৌশলে সরে এসেছেন তারাও।
শিক্ষা উপমন্ত্রী ও কোতোয়ালি আসনের এমপি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ‘পরিবেশগত ঝুঁকি আছে এমন কোনো সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নেবেন না’ মন্তব্য করে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধেই নিজের অবস্থান জানান দিয়েছিলেন। কিন্তু গত দেড় মাসে সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সাড়া না মেলায় নওফেল এবং বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের এমপি মোছলেম উদ্দিন তাদের অবস্থান পাল্টে ফেলেছেন।
গত সোমবার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ছয় শয্যার এইচডিইউ উদ্বোধন শেষে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ বিষয়ে সাংবাদিকদের নওফেল বলেন, ‘এটা সরকারের একটা নির্বাহী সিদ্ধান্ত। আমি যেহেতু সরকারের একটা নির্বাহী দায়িত্বে আছি; এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’ তার এমন বক্তব্যের পরেই গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোছলেম উদ্দিন নিজের অবস্থানের পক্ষে বলেন, ‘আজকে নওফেলের (শিক্ষা উপমন্ত্রী) বক্তব্যের পরে চট্টগ্রামবাসী জ্ঞাত হয়ে যাবে। দেখবেন যে আরও অনেকে এটার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবে।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সিআরবি রক্ষায় গঠিত নাগরিক সমাজের সভাপতি ড. অনুপম সেন বলেন, ‘সিআরবিকে বলা হয় অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। হাসপাতাল হলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এক সময় কাটা পড়বে শতবর্ষী অনেক গাছও। আমরা তাই হাসপাতালটি অন্য জায়গায় স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছি আমরা। তিনি আমাদের অভিভাবক। তিনি পুরো দেশের অভিভাবক। আমরা ওনার বিরোধিতা করিনি কখনোই।’
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে হাসপাতাল স্থাপনের বিরোধিতা করেননি কেউই। শুধু স্থান নিয়ে দ্বিমত রয়েছে আমাদের। সিআরবির বাইরে যে কোনো স্থানে হতে পারে এ হাসপাতাল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’
একই মন্তব্য করে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা বলে যারা এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতে চায়, তাদের সম্পর্কে জানা আছে নগরবাসীর। এখানে এসে একাত্মতা পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন অনেকে। এখন আবার কেন তাদের ভিন্ন সুর, তা আমরা বুঝি। এ আন্দোলন ৬০ লাখ নগরবাসীর। এ আন্দোলন সবুজ রক্ষার।’