ফিজিও তহিদ রাসেল, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধানঃ
চলতি বছরে ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। তার পরের দিনই প্রকাশিত ফলাফলে অসঙ্গতি নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথাও ছিল। পরবর্তীতে আরও সাত কর্মদিবস বাড়িয়ে দিতে আবেদন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
ফলাফলে অসঙ্গতি আর তাই নিয়ে এই তদন্ত কমিটি, এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। বিপত্তি বাধলো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার একদিন আগে। তদন্ত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। যা নিয়ে খোদ শিক্ষাবোর্ডেই চলছে কানাঘুষা। তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিজেই প্রতারণা এবং অসদাচরণের আশ্রয় নিয়েছেন বলে মন্তব্য বোর্ড কর্মকর্তাদের।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দেওয়া চিঠির সূত্র ধরে দেখা যায়, গত ১ মার্চ চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর একটা চিঠি দেন। সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের উদ্ধৃত দিয়ে সেই চিঠিতে তদন্ত কমিটির সদস্যরা পরীক্ষার ফলাফলের গোপনীয় ও স্পর্শকাতর তথ্য পেনড্রাইভে করে বোর্ডের বাইরে নিয়ে গেছেন— এমন অভিযোগ করেন।
সেইসঙ্গে চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, পেনড্রাইভে করে তথ্য বাইরে নেওয়ার আগে তাঁর অনুমতি নেওয়া হয়নি। ঠিক তারপর দিন ২ মার্চ চেয়ারম্যান বরাবর আরেকটা চিঠি দেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। সেই চিঠিতে তিনি তদন্ত কমিটির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের অভিযোগ তুলে তদন্ত কমিটি থেকে তাঁদের অপসারণের জন্য অনুরোধ জানান। এ অভিযোগের একদিন পর ৩ মার্চ কর্তৃপক্ষকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
এদিকে, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ১ মার্চের দেওয়া চিঠিতে থাকা অভিযোগের ব্যাখ্যা চেয়ে সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানকে চিঠি দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল আলীম। সেই চিঠির ব্যাখ্যায় সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট লিখিতভাবে জানান, তদন্ত কমিটিকে দেওয়া যাবতীয় তথ্য গোপনীয় কিংবা স্পর্শকাতর ছিল না। যা দিয়েছেন সেটা ২০২১ সালের এইচএসসির রেজাল্ট। যা কোনভাবেই গোপনীয় নয়। অথচ সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের দেওয়া ব্যাখ্যার সেই চিঠি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ নিজেই স্বাক্ষর করে চেয়ারম্যানের কাছে ফরোয়ার্ড করেছেন। যেখানে তথ্য সরবরাহকারী সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট বলেছে গোপনীয় নয়। আর সেখানেই তার (সিস্টেম এনালিস্ট) বরাত দিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলছেন গোপনীয়।
তবে বোর্ডের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ ১৬তম ব্যাচের আর তদন্ত কমিটির আহবাহক ও পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ১৩তম ব্যাচের। এছাড়াও বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কমিটি ‘নাম ও বয়স সংশোধনী’ কমিটিতে প্রায় এক বছর ধরে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পাশে বসেই কাজ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রসঙ্গ এনে জুনিয়র কেউ সিনিয়রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে বলেও মন্তব্য বোর্ড কর্মকর্তাদের।
এছাড়াও তদন্ত কমিটির আহবাহক ও পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে কি সিটি মেয়রও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছেন এমন প্রশ্নই করেছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
এদিকে, পেনড্রাইভে করে তথ্য বোর্ডের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও গঠিত তদন্ত কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটির সবাই বোর্ডে বসেই কাজ করেছি এবং বোর্ডের একজন কর্মকর্তা এ কমিটিতে আছেন, উনার কাছে সব জমা রেখে আমরা বের হতাম। আমরা কোনো তথ্য বাইরে নেইনি। এমনকি বাইরে বসেও কাজ করিনি। আমাদের কি কি তথ্য লাগবে তা লিখিতভাবেই জানিয়েছি। তাছাড়া সিস্টেম এনালিস্টও লিখিতভাবেই চেয়ারম্যানকে জানিয়েছেন তিনি আমাদের কোনো গোপনীয় বা স্পর্শকাতর তথ্য দেননি।’
রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে তার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে এই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। জিজিএফআই আছে, এনএসআই আছে, সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা দপ্তর আছে, সরকার চাইলে দশ বছরের ইতিহাস দুই মিনিটেই বের করতে পারে।
অন্যদিকে, সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বরাত দিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যে অভিযোগ করেছেন। সে বিষয়ে জানতে কথা হয় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘না না, কোনো গোপনীয় কিংবা স্পর্শকাতর তথ্য দেইনি। কারণ আমাদের যে ট্যাবুলেশন ফাইল আছে তা দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় ডেমু দেওয়ার জন্য। এখানে সেনসিটিভ বা স্পর্শকাতর কোনো ডাটা থাকে না।’
জানা যায়, তদন্ত কমিটির সদস্যরা তদন্ত শেষে যাবতীয় সকল তথ্যাদি কমিটির আরেক সদস্য ও বোর্ডের সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদারের কাছে রেখে যেতেন। তিনি সেই সকল বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সম্পাতা তালুকদার প্রথমে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ না করে বলেন, ‘আপনি একটু কাইন্ডলি আমাদের কমিটির আহ্বায়কের সঙ্গে কথা বলেন।’
শেষে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, পেনড্রাইভ আমার কাছে ছিল। আমাদের কোনো তথ্য বাইরে নেওয়া হয়নি বা আনাও হয়নি। আমরা বোর্ডে বসেই তদন্তের কাজ করেছি। তদন্ত শেষে লিখিতভাবেই তা আমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি।’
একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালের এইচএসসির ফল প্রকাশের পর নির্ধারিত ওয়েবসাইটে কিছু শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর দুপুরে একরকম ছিল আবার রাতে আরেকরকম হয়ে যায়। এ ঘটনায় বোর্ড কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার একদিন আগে কমিটির সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অভিযোগ তুলেন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।