সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি ও তার মেয়ে তানজিন বৃষ্টিকে হয়রানির অভিযোগে ইতিহাদ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে দুই কোটি টাকা জরিমানা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। এক কোটি করে মোট দুই কোটি টাকা প্রত্যেককে প্রদান করতে পরবর্তী মাস থেকে ২০ কিস্তিতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া নারীযাত্রীদের সঙ্গে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতে রায়ে ইতিহাদ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুন) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের বেঞ্চ ১৯২ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করে।
রিটকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নয় বছর আগে বাংলাদেশি দুই নাগরিক অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুঁথি ও তার মেয়ে তানজিন বৃষ্টিকে হয়রানির অভিযোগে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে ইতিহাদ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে গত বছরের ৮ অক্টোবর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল আংশিক মঞ্জুর করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আদালত বলেন, দুজন নারীকে আবুধাবি বিমানবন্দরে যে ধরনের হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে, তা অর্থদণ্ড দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।
আদালত ‘নেগলিজেন্স গেস টর্ট’ আইনের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের রায় প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এ ছাড়া আদালত ইতিহাদ এয়ারলাইনসকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করেন, যেন জেন্ডার বা শরীরের রং বিবেচনায় ভবিষ্যতে কোনো যাত্রীর সঙ্গে এ রকম আচরণ করা না হয়।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট রিপন বাড়ৈ। ইতিহাদের কান্ট্রি ম্যানেজারের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আজমালুল হোসেন কিউসি ও মো. আজিজ উল্লাহ ইমন।
২০১১ সালে ২৮ জুন কানাডা যাওয়ার জন্য ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের ইতিহাদ এয়ারলাইনসের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নেন তানজিন বৃষ্টি ও তার মা নাহিদ সুলতানা যুথি। তার মধ্যে একটি ঢাকা-আবুধাবী EY 253 ফ্লাইটের জন্য, অন্যটি আবুধাবী-টরন্টো EY 141 ফ্লাইটের জন্য। পরদিন সকাল ৮টায় তারা আবুধাবি বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাদের পরবর্তী ফ্লাইটটি (আবুধাবি-টরন্টো) আবুধাবীর স্থানীয় সময় রাত ১০টায় নির্ধারিত ছিল। যথাসময়ে তারা EY 141 ফ্লাইটের জন্য লাইনে দাঁড়ান।
চেক-ইন শেষে তানজিন বৃষ্টিকে ওয়েটিং রুমে ঢুকতে দিলেও বোর্ডিং পাসে সিল না থাকায় তার মা নাহিদ সুলতানা যুথিকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে ইতিহাদের কর্মীরা মা ও মেয়েকে জোর করে দেশে ফিরতে বাধ্য করেন।
ঢাকায় ফিরে তানজিন বৃষ্টি ২০১১ সালের ৩০ জুন বিমানবন্দর থানায় জিডি করেন। পরে ই-মেইলে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (আইসিএও) কাছেও অভিযোগ করেন। এরপর ওই বছরের ৪ জুলাই ঢাকায় ইতিহাদের কান্ট্রি ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জমা দিয়ে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন বৃষ্টি। তাতে সাড়া না পেয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত ওই বছরের ১৪ জুলাই রুলসহ আদেশ দেয়। আদালত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলে। সেই সাথে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কান্ট্রি ম্যানেজারকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
আটক, হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ বিচারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এ দুই যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে সে সময় রুলও জারি করে হাই কোর্ট।
ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কান্ট্রি ম্যানেজার হাজির হয়ে ব্যাখ্য দেওয়ার পর মামলার রুল শুনানির শুরু হলে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের আদালত মামলাটি শুনানিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে প্রধান বিচারপতি রুল শুনানির জন্য মামলাটি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চে পাঠান। শুনানি শেষে গত বছর ৮ অক্টোবর ওই বেঞ্চ রায় দেয়।
২০১৮ সালে ১৪ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, এটি কাচের মত স্পষ্ট যে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কর্মকর্তারা রিট আবেদনকারী এবং তার মায়ের সাথে অন্যায়, রুঢ়, অপেশাদার,অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল এবং আবেদনকারীর মায়ের বোর্ডিং পাসে সিল না থাকার বিষয়টি সমাধান না করে অন্যায়ভাবে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের সহধর্মিণী।