মাসুদ রানা,সিনিয়র রিপোর্টারঃ র্যাব-৩ বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপের সদস্য কর্তৃক ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিশোর গ্যাং বা গ্যাং কালচার উঠতি বয়সী ছেলেদের মাঝে ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এসকল গ্যাংসমূহের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংঘর্ষ সমাজে ব্যাপক মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।গ্যাংসমূহের পারস্পরিক মারামারি, ক্ষমতা জাহির করতে প্রকাশ্য অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক সেবন, যত্রতত্র ছিনতাই, প্রাণ নাশের হুমকি প্রদান প্রভৃতি সমাজে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এমন কোন ঘটনায় কেউ কোন প্রতিবাদ করলে অনেক সময় খুন করতেও এরা দ্বিধাবোধ করেনা। রাস্তাঘাটে নারীদের ইভটিজিং ও শ্লীলতাহানি এসকল সদস্যদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম।
এছাড়াও তারা বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং এর মাধ্যমে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলে এবং নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। এ সকল সন্ত্রাসীদের হামলা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরী ও মামলা রুজু হয়। অতি সম্প্রতি তেজগাঁও, কলাবাগান, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর, ডেমরা ও তার আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সম্পর্কে তথ্য পায় র্যাব। ফলশ্রুতিতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়।
র্যাব-৩ এর গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজধানীর তেজগাঁও, কলাবাগান, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর ও ডেমরা থানাধীন এলাকায় কতিপয় কিশোর গ্যাং এর কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায় যে, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নামে পেশীশক্তি প্রদর্শন করে আসছে। তারা মাদক সেবন, সাইলেন্সারবিহীন মোটরসাইকেল চালিয়ে বিকট শব্দ করে জনমনে ভীতির সঞ্চার, স্কুল-কলেজে বুলিং, র্যাগিং, ইভটিজিং, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক সেবন, অস্ত্র প্রদর্শন এবং অশ্লীল ভিডিও শেয়ারসহ নানাবিধ অনৈতিক কাজে লিপ্ত, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিশ্চিত ক্ষতির মুখে ধাবিত করছে। এরই প্রেক্ষিতে কিশোর গ্যাং এর বিপথগামী সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব-৩ সাস্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা নজরদারী আরও বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ৬ মার্চ ২০২৪ ইং রাত ৫ টা হতে ৭ ঘটিকায় র্যাব-৩ এর পৃথক পৃথক আভিযানিক দল গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর তেজগাঁও, কলাবাগান, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর ও ডেমরা থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কিশোরগ্যাং ‘অটো সজল’ গ্রুপের ৮ জন, ‘খোকন’ গ্রুপের ৭ জন, ‘ইউনুস’ গ্রুপের ৫ জন, ‘আনোয়ার’ গ্রুপের ৪ জন, ‘মানিক’ গ্রুপের ৫ জন এবং ‘রাহুল’ গ্রুপের ৫ জন সহ সর্বমোট ৩৪ জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এদের প্রতিটি কিশোরগ্যাং গ্রুপে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য থাকে। অটো সজল গ্রুপটি সন্ত্রাসী মোঃ সাদ্দাম হোসেনের মদদে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচালিত হয়ে আসছে। নিজেদের মধ্যে আন্তঃকোন্দলের কারনে তারা ২/৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়। খোকন গ্রুপটি গ্রেফতারকৃত রাজা এর মদদে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচালিত হয়ে আসছে। গ্রেফতারকৃতরা রাজধানীর গেন্ডারিয়া ও আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা একাকী পথচারীদের আকস্মিকভাবে ঘিরে ধরে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যেতো।
তারা বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, বংশাল, চকবাজার এলাকাসহ আশপাশ এলাকায় দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারিসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এছাড়াও তারা মাদক সেবনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিল।
এছাড়াও তেজগাঁও ও কলাবাগান এলাকায় ইউনুস এবং আনোয়ার গ্রুপ দুইটি দীর্ঘদিন যাবত সন্ত্রাসী ইউনুস এবং আনোয়ার এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে। এরা রাজধানীর তেজগাঁও, আগারগাঁও, কলাবাগান, খিলগাঁও এবং এর আশেপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এই গ্রুপের সদস্যরা সাইলেন্সারবিহীন মোটরসাইকেল দ্বারা বিকট শব্দ করে তেজগাঁও ফ্লাইওভার এলাকায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে অপরবাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
গ্রেফতারকৃত গ্রুপের মধ্যে মানিক গ্রুপটি রাজধানীর শ্যামপুর, কদমতলী, যাত্রাবাড়িসহ আশপাশের এলাকায় ধৃত মোঃ মানিকের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত রাহুল গ্রুপটি সন্ত্রাসী রাহুল গাজীর নেতৃত্বে ডেমরা এলাকায় তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তারা উক্ত এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং বিভিন্ন মানুষকে হুমকি, মারধরসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম করে আসছে। রাহুল গাজীর নেতৃত্বে তার গ্রুপটি গত ২৫/২৬ দিন পূর্বে ডেমরা এলাকায় নগদ অর্থ ও মোবাইলফোন ছিনতাইকালে আরমান নামে এক কিশোর তাদেরকে বাধা দিলে তারা আরমানকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে পেটের নাড়ি-ভুড়ি বের করে দেয়। তাদের মূল টার্গেট ছিল বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা। এছাড়াও তারা মানিক ও রাহুল গাজীর নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতো বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত কিশোরগ্যাং এর মদদদাতা ও সদস্যরা পেশায় অটো-রিক্সা চালক, ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী, দিনমজুর, দোকানের কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক, পুরাতন মালামাল ক্রেতা, সবজি বিক্রেতা হলেও মূল পেশার আড়ালে তারা মূলত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
নাঈম সজল
সময় এক্সপ্রেস নিউজের সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
Leave a Reply