আগামী নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সবকিছু ঠিক থাকলে বর্তমান সংসদের মেয়াদ অক্টোবরেই শেষ হবে। মানে আর তিনমাস। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় আসছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড-এর নেতৃত্বে প্রভাবশালী প্রতিনিধি দল, যাদের সফরের পর অনেককিছুই ঘটবে। আর নুলান্ড যখন ঢাকায় ঠিক ওই সময়ে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ন, কারণ এটার মাধ্যমে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। অর্থাৎ, এই উপনির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় কিনা এটাই মূলত বিবেচনায় নেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।
ভিক্টোরিয়া নুলান্ড তাঁর সফরকালে বিএনপি, জামায়াতসহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিক, এনজিও প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের সাথে সিরিজ বৈঠক করবেন। এই সফরের প্রস্তুতি হিসেবে এরইমাঝে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন রিপোর্ট এমনকি সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়’র ওপর নজর রাখছে এবং এবিষয়ে প্রতিদিন ওয়াশিংটনকে অবহিত করছে। একটা বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এরইমাঝে ভিক্টোরিয়া নুলাণ্ড ও ডোনাল্ড লু’র যৌথ সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি তাঁদেরকে নিয়ে ঢাকার ওয়েষ্টিন হোটেলে একটা অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালাচ্ছে। মূলত ওই টিভি চ্যানেলের একজন উপস্থাপককে এবিষয়ে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছেন বিএনপির দ্বিতীয় সারির এক নেতা।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি একযোগে সংসদে বিরোধী বেঞ্চ এবং সরকারে থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এদেরকে বিরোধীদল হিসেবে গণ্য করেনা। বরং আমেরিকার দৃষ্টিতে মূল বিরোধীদল বিএনপি এবং জামায়াত।
জাতীয় পার্টির একাংশের (জাতীয় পার্টিতে এখন দুটো গ্রুপ – রওশন এরশাদ গ্রুপ এবং জিএম কাদের গ্রুপ) চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের বারবার বলছেন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাঁর নেতৃত্বে থাকা জাতীয় পার্টির একাংশ নির্বাচন বয়কট করবে। কদিন আগেই তিনি তাঁর দলের আরো দুজন নেতাসহ দুবাই ঘুরে এসেছেন। সেখানে তিনি বা তাঁর দলের দুই নেতা কার বা কাদের সাথে বৈঠক করেছেন এসব তথ্য আমরা অনেকেই জানি।
নির্বাচনে অংশ না নেয়া প্রসঙ্গে জিএম কাদেরের বক্তব্যকে অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কারণ, এরা সবারই জানা, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে জাতীয় পার্টির আদতেই কোনো গুরুত্ব থাকবেনা। নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মাঝে। তৃতীয় ফ্যাক্টর হিসেবে থাকবে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলো। সবচেয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা হবে বামপন্থী দলগুলোর, কারণ আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপির আশীর্বাদ ছাড়া এদের পক্ষে একটা আসনেও বিজয়ী হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই।
বর্তমান সংসদের মেয়াদ যেহেতু আর তিনমাস আছে তাই বেশ আগে থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকার পাশাপাশি বর্তমান সংসদে থাকা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের সিলেক্টেড এমপিদের পাশাপাশি মহাজোটের অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বকারী এমপিদের আমলনামা তৈরী হচ্ছে কিংবা হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এটুকু বলতে পারি, শতকরা প্রায় ত্রিশভাগ এমপি আগামীতে আর মনোনয়ন পাচ্ছেন না। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের জন্যে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। তাই আওয়ামীলীগ এর জোটভুক্ত দল কিংবা জাতীয় পার্টিকে ওই আসনগুলোই ছাড়বে যেগুলো মূলত বিএনপির ষ্টংহোল্ড কিংবা যেসব আসনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সবচেয়ে বিপদে পড়বে জাতীয় পার্টি। কারণ একাধিক। প্রথমত জাতীয় পার্টির সারাদেশে মোট ভোট ব্যাংকের সংখ্যাটা শতকরা ৩-৫ ভাগ। দ্বিতীয়ত জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়ায় এদেরকে জনগন কিংবা ভোটাররা আর বিরোধী দল মানতে নারাজ। জাতীয় পার্টির জিএম কাদের নিজেও আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ওনার দলের আরো অনেকেই সরকারে যোগ দিয়েছেন। মোদ্দা কথায় জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব যদি নিজেদের বিরোধীদল হিসেবে প্রমাণ করতে চান তাহলে তাঁদেরকে অন্তত আগামী পাঁচ বছর প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, যা তাঁরা করবেন কিনা আমার জানা নেই। গত চৌদ্দ বছরে সরকারে থেকে কিংবা কথিত বিরোধীদল হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পর শেষ মুহূর্তে এসে জিএম কাদের কিংবা তাঁর দলের নেতারা যদি নিজেদের বিরোধী রাজনৈতিক হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, তাহলে লাভ নেই। রাজনীতি করতে হলে জেল খাটতে হবে। এয়ারকন্ডিশন কামরায় বসে রাজনীতিবিদ হওয়া যায়না। কিংবা সুবিধাবাদী ভূমিকা পালন করে কেউই রাজনীতিতে শেষতক জায়গা পায়না। একারণেই আমার বিবেচনায়, আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টি আসলে কি বললো বা না বললো, তাতে কিছুই আসে যায়না। কারণ, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ফ্যাক্টর মূলত আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত। জাতীয় পার্টির আরেকটা দুর্বলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এটা এই দলের নেই। জিএম কাদের যদি ভাবেন কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত মানেই ওই দেশ কিংবা রাষ্ট্রদূত যা বলেন সবই স্বর্গীয় বাণী, তাহলে তিনি ভুল করছেন। রাষ্ট্রদূতেরা হচ্ছেন কূটনীতিক। তাঁদের মনে কি আছে এটা বোঝার জন্যে অনেক বিচক্ষণ হতে হবে। রাষ্ট্রদূত এক বা একাধিক দিন তাঁর অফিস বা বাসায় ডাকলেন কিংবা জিএম কাদেরের বাসায় গেলেন, এতেই যদি ধরে নেয়া হয়, ওই দেশ জাতীয় পার্টির পক্ষে তাহলে এটা শুধু ভূলই নয়, ভীষন হাস্যকর।
আমি ১৯৮৯ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার কাজ করেছি। আমার বাসায় নিয়মিতভাবে রাশিয়ান এম্বেসেডর, চাইনিজ এম্বেসেডর, ভারতীয় হাইকমিশনার সহ বহু কূটনীতিক আসাযাওয়া করতেন। স্রেফ বন্ধুত্বের সুবাদে। এটাকে তো বিদেশী কানেকশন ধরা ভুল। এখনও আমার সাথে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি, আরএসএস, আমেরিকার দুই প্রধান দল, রাশিয়ার শীর্ষ অনেক নেতা, চীনের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। তাই বলে কি আমি নিজেকে ওই দেশগুলোর বা দলগুলোর আশীর্বাদপুষ্ট ভাবতে পারবো? মোটেও না। কারণ আমার সাথে ওদের এই সম্পর্ক একদম ব্যক্তিগত। এখানে রাজনীতি কিংবা কূটনীতির কোনো জায়গায়ই নেই।
জাতীয় পার্টির যদি আগামীতে রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে অবশ্যই এই দলকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ, বর্তমান ভুরাজনৈতিক বাস্তবতায় এটার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী।
আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় আছে জানি। কেউকেউ বলছেন নির্বাচন হবেনা। আবার কেউকেউ অন্য ধরনের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। আমি বিনয়ের সাথে সবাইকে বলছি – নির্বাচন হবে এবং সঠিক সময়েই হবে। আরেকটা কথা বলে রাখি। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি শেষতক অংশ না নেয় তাহলে জাতীয় পার্টি প্রচণ্ড খুশীমনে নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে, এই সম্ভাবনা একদম ক্ষীণ। কারণ, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে। চলতি মাসের দ্বিতীয়ভাগে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড-এর নেতৃত্বে প্রভাবশালী প্রতিনিধি দল ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পরপরই কিংবা ওদের বাংলাদেশে অবস্থানকালেই এটা পরিষ্কারভাবে আমরা সবাই বুঝে যাবো।
লেখক: সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী- সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
নাঈম সজল
সময় এক্সপ্রেস নিউজের সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
Leave a Reply